শনিবার
০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শনিবার
০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

১৬ বছর ধরে সুবিধাবঞ্চিত তাঁতীদের জীবন আজও আঁধারে

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১১ পিএম
খোলা বাজার থেকে দ্বিগুন দামে রং-রাসায়নিক কিনে সুতাকে রঙিন করেছে তাঁতীরা
expand
খোলা বাজার থেকে দ্বিগুন দামে রং-রাসায়নিক কিনে সুতাকে রঙিন করেছে তাঁতীরা

বাংলাদেশের তাঁতীদের জন্ম যেন আজন্ম পাপ। অতীতের সরকারগুলোও তাঁতীদের ওপর সুনজর দেয়নি। বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের জাঁতাকলে এ শিল্পটি ধ্বংসের পথে যেতে থাকে, বন্ধ হয়ে যায় ৬০ ভাগ তাঁত, বেকার হয়ে পড়ে ১৫ লাখ তাঁতী ও তাঁত শ্রমিক।

গত বছরের আগস্টে পটপরিবর্তনের পর তাঁতীরা আশায় বুক বেঁধেছিল যে, এবার বুঝি তাদের ভাগ্য খুলবে। কিন্তু ইউনূস সরকারে গত এক বছরে তাঁতীদের ভাগ্য সেই আগের আঁধারেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক সহযোগীতা ও সুনজর না থাকার কারণে তাঁতশিল্প এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

তাঁতীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে তাঁতীদের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা বিতরণ ও আংশিক শুল্কমুক্ত সূতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানি সুবিধা বন্ধ রয়েছে। তাঁত বোর্ডে সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানি সুপারিশ বন্ধ থাকায় খোলা বাজারে এর দাম এখন দ্বিগুণ হয়েছে।

তাঁতীরা খোলা বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে সুতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যাদি ক্রয় করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাপড় তৈরিতে খরচ বেশি পড়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ফলে অনেক তাঁতী পেশা ত্যাগ করছেন।

তাঁতীরা জানান, এর আগে তাঁতীরা ন্যায্যমূল্যে আংশিক শুল্কমুক্ত সুতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যাদি পেত। বর্তমানে তা বন্ধ আছে। তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা বিতরণ ও আংশিক শুল্কমুক্ত সূতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে তাঁতশিল্পের উন্নতি ও প্রসার ঘটবে এবং সেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাঁতশিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য (আংশিক শুল্কমুক্ত) আমদানি করা একান্তই প্রয়োজন।

তাঁতীদের দাবি, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের অধীনে প্রাথমিক তাঁতী সমিতি রয়েছে ১৩৬০টি। জাতীয় তাঁতী সমিতির মাধ্যমে এই প্রাথমিক তাঁতী সমিতিগুলোকে প্রচলিত আংশিক শুল্কমুক্ত সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।

এছাড়াও এই ১৩৬০টি সমিতির সকল সদস্যকে তাদের অচল তাঁতগুলো সচল করতে ও যাদের তাঁত আছে কিন্তু পুঁজি নেই তাদের মাঝে ঋণ বিতরণ করতে হবে। শেখ হাসিনা পলায়নের পর থেকে তাঁতীদেরকে কোনো প্রকার ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়নি।

গত ২/৩ মাস আগে দুটি প্রাথমিক তাঁতী সমিতিকে (প্রায় ২০ কোটি টাকার) সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির সুপারিশ দেওয়া হলেও সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতী সমিতিটির আমদানি সুপারিশ স্থগিত করা হয় ১৬ জুলাই তারিখে তাঁত বোর্ডের বোর্ড মিটিং থেকে।

স্থগিতের কারণ হচ্ছে, এই সমিতির আওতায় আরও ৪০০ জন তাঁতীর প্রায় ২ হাজার তাঁত রয়েছে, সেগুলোকে সমিতির সদস্যভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু সুপারিশ স্থগিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁত বোর্ডের ডি.জি.এম.-এর চক্রচাল খেলায় সিরাজগঞ্জের একটি ব্যাংক শাখায় অবৈধভাবে এলসি খোলা হয়েছে।

এ বিষয়ে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু আহমদ সিদ্দিকী টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, এলসি খোলার বিষয়টি স্থগিত করা হয়েছে। আমদানির জন্য এলসি খুলতে তাদের নিষেধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এলসি না খোলার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে, আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে, চট্টগ্রাম ও বেনাপোল কাস্টম হাউসকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের ডি.জি.এম. রতন চন্দ্র সাহা এ প্রতিবেদককে বলেন, সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির সুপারিশ দেওয়া হলেও সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতী সমিতিটির আমদানি সুপারিশ স্থগিত করা হয়। তার পরেও তারা কিভাবে এলসি খুললো এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারবো না। এর উত্তর আমাদের জানা নেই। স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও যারা এলসি খুলেছে এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।

সূতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানি বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে রতন চন্দ্র সাহা বলেন, সুতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানি আপাতত বন্ধ রয়েছে। এটা সমাধানের জন্য আমরা কাজ করছি। আমদানি সুপারিশের কার্যক্রম শুরু হলে তাঁতীদের সমস্যা সমাধান হবে বলে আমি মনে করি। তাঁতীদের জন্যই তো তাঁত বোর্ডের সৃষ্টি হয়েছে।

জাতীয় তাঁতী সমিতির সেক্রেটারি ফজলুল হক জানান, পোষক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কর্তৃক ইস্যুকৃত সুপারিশ স্থগিত করার পর কোনো অজুহাতেই এলসি খুলতে পারে না। তাঁত বোর্ডকে সংশ্লিষ্ট তফসিলি ব্যাংকে অবশ্যই পত্র প্রেরণ করতে হবে। এ ছাড়া কাস্টমস হতে মাল খালাস হবে না।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার একজন বিশিষ্ট তাঁত ব্যবসায়ী হাফিজ উদ্দিন শতাধিক তাঁতে শাড়ি, লুঙ্গি সহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় তৈরি করেন। তার উৎপাদিত কাপড় দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ব্যবসায়ীরা শাহজাদপুর বিশাল কাপড়ের হাটে এসে কিনে নিয়ে যায়। তার উৎপাদিত কাপড় বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে।

তিনি বলেন, যেহেতু দেশে-বিদেশে তাঁতীদের উৎপাদিত কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সমিতিভুক্ত তাঁতীরা কাপড় উৎপাদনের ক্ষেত্রে আর্থিক ঋণ সহযোগিতা আর আংশিক শুল্কমুক্ত সুতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি সুবিধা পেলে কাপড় উৎপাদন ও বিক্রি করে তাঁত ব্যবসায় তাঁতীরা লাভবান হতো, সেই সঙ্গে লাখ লাখ লোকেরও কর্মসংস্থান হতো। এ বিষয়ে এখন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে তাঁতশিল্পের উন্নয়নে সরকারের সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন