

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


চলতি বছর বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্পে প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধির পর চলতি বছরে রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য চাপের মুখে পড়েছে, যা অর্থনীতির জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২০২৩ সালে ছিল ৩ হাজার ৫৮৯ কোটি ডলার। পরের বছর ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮৪৮ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ৭.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় পোশাক রপ্তানিতে। তবে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৫৫৯ কোটি ডলার। এ সময়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ২.৫৩ শতাংশ। যেখানে ২০২৪ সালের একই সময়ে ২০২৩ সালের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছিল ৬.২৩ শতাংশ। ফলে চলতি বছর পূর্ণ হিসাবেও ২০২৪ সালের প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২০২৫ সালে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে একাধিক নেতিবাচক ঘটনা ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান বাজারগুলোতে সম্ভাব্য শুল্ক আরোপের হুমকি এবং অর্ডার স্থগিতাদেশ রপ্তানিকারকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবসার গতি ধীর করেছে এবং স্বাভাবিক বাণিজ্য কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটিয়েছে।
গণ অভ্যুত্থানের পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষও রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন সময় সড়ক অবরোধ, কর্মবিরতি ও কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ও পণ্য পরিবহণ ব্যাহত হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কাস্টমস হাউসের সম্পূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রপ্তানি কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে—যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও বিরল ঘটনা। এমন একটি অর্থনীতিতে, যেখানে প্রায় পুরো রপ্তানি আয়ই তৈরি পোশাক খাতনির্ভর, এ ধরনের প্রতিবন্ধকতাগুলো অত্যন্ত গুরুতর প্রভাব ফেলেছে।
এ ছাড়া দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালাল এয়ারপোর্টে কার্গো অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য নষ্ট হওয়ায় সরাসরি রপ্তানি আয়ে বড় ক্ষতি হয়। একই সময়ে রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহার এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
তাৎক্ষণিক ধাক্কার পাশাপাশি দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতাও সামনে চলে এসেছে। ইউরোপের বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের অবস্থান সংকুচিত করছে। অন্যদিকে অপ্রচলিত ও নতুন বাজারগুলোতে প্রত্যাশিত সাফল্য না পাওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো কয়েকটি বড় বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার ঝুঁকি আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্যের বৈচিত্র্য ও উচ্চ মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো দ্রুত প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ও নতুন বাজারে প্রবেশ করে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে শ্রমিক অধিকার জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও, এতে কারখানা মালিকদের জন্য সম্মতি ব্যয় ও পরিচালনগত চাপ বেড়েছে। সঠিক সমন্বয় ও বাস্তবায়ন না হলে শিল্পে নতুন ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, কারখানা বন্ধ হওয়ার মূল কারণগুলো দ্রুত শনাক্ত ও সমাধান করা জরুরি। পাশাপাশি শিল্পখাতে স্থিতিশীল অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নতুন কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রেও কার্যকর নজরদারি দরকার, যাতে তা জাতীয় শিল্প উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতাশীলতা নির্ভর করবে অবকাঠামো উন্নয়ন, লজিস্টিকস শক্তিশালীকরণ, অভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং মূল্য সংযোজনের উচ্চ ধাপে অগ্রসর হওয়ার ওপর। গবেষণা ও উন্নয়ন, উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক বিপণনে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপরও জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা মনে করছেন, বর্তমান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উৎপাদন সক্ষমতা, শ্রমশক্তি এবং দীর্ঘদিনের ক্রেতা সম্পর্ক বাংলাদেশের বড় শক্তি। সমন্বিত নীতি সহায়তা ও সঠিক কৌশল বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ আবারও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে পারে।
মন্তব্য করুন
