মঙ্গলবার
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মঙ্গলবার
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পরকালের ভয়, মানবিকতা ও নিষ্ঠার ১৬ বছরে শামছুদ্দিন

তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০৪ পিএম
শামছুদ্দিন মিয়া (৬৫)
expand
শামছুদ্দিন মিয়া (৬৫)

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল সদর ইউনিয়নের সাচাইল কবরস্থানের নীরব আঙিনায় ১৬ বছর ধরে এক মানুষ কাজ করে যাচ্ছেন নিষ্ঠা, বিশ্বাস ও মানবিকতার গভীরতায়। তিনি উপজেলার কালনা গ্রামের মৃত শহর আলীর ছেলে শামছুদ্দিন মিয়া(৬৫)।

জেলার অন্যতম অভিজ্ঞ গোড়খোদক, যিনি নিজের জীবনের বড় অংশ উৎসর্গ করেছেন মানুষের শেষ যাত্রার সেবায়।

১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত সাচাইল কবরস্থানটি ২৮০ শতাংশ জমির ওপর অবস্থিত। এর মধ্যে ২৫০ শতাংশ কবরস্থান আর বাকি অংশ দোকানঘর। এই বিস্তীর্ণ কবরস্থানের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পথ, প্রতিটি মাটি যেন সাক্ষী শামসুদ্দিনের নিরলস পরিশ্রমের।

গোড়খোদক শামছুদ্দিন বলেন,আমি পরকালের শাস্তির ভয় পাই। মানুষের শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়াটা সোহাগের কাজ মনে করে এত বছর ধরে এই কাজ করছি। আমি টাকার জন্য করি না মানুষের সেবার জন্য এই কাজ করি। এই এক বিশ্বাসে তিনি টিকে আছেন ১৬ বছর ধরে।

এ পর্যন্ত ৫৫২টি কবর খোড়ার কাজ করেছেন তিনি।২৪ ঘণ্টা ডাকে সাড়া দেন তিনি। ঝড়-বৃষ্টি, গভীর রাত—কিছুই তাঁকে থামাতে পারেনি।

তাঁর হাতে রয়েছে ১৫ ধরনের ডিজাইনের কবর তৈরির দক্ষতা,যা তাঁকে আলাদা মর্যাদা এনে দিয়েছে।করোনা আক্রান্ত মৃতদেহের দায়িত্ব নিতে যখন সবাই পিছিয়ে গেছেন, তখন সামনে এগিয়ে গেছেন তিনি।

তিনি বলেন, সদর বাজারের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী করুনায় মারা গেলে উপজেলা প্রশাসনের সামনে আমি নিজেই গোড়খোদকের কাজ করি। জীবনটা তখন ভয়েই কেটেছিল,তবুও দ্বায়িত্ব ছাড়িনি। এই দিনগুলো তাঁর সাহসিকতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।

সুপারি, নারকেল, মেহগনি সহ বিভিন্ন গাছ তিনি নিজ হাতে লাগিয়েছেন।পরিচর্যা করেন প্রতিদিন। আজ কবরস্থানের শান্ত, ছায়াময় পরিবেশ তাঁরই হাতের কাজ।

উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া কাঞ্চন এঁর জন্য বিশেষ ডিজাইনের কবর খোড়ার কাজ করেছিলেন তিনি। কাজ দেখে প্রশংসা করেন সাবেক এমপি মুজিবুল হক চুন্নু।

উপজেলা বিএনপি সভাপতি সারোয়ার হোসেন লিটন তাঁর মায়ের কবর খোড়ার কাজ করে দিলে তাকে ১০হাজার টাকা উপহার দেন।

সদালোপী শামছুদ্দিন জানান, এত বছর ধরে এতো গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও কখনো কোন সরকারি ভাতা,অনুদান বা সহায়তা পানি তিনি।

১৬বছর আগে যখন এ কাজ শুরু করেন তখন কবরস্থান কমিটি মাত্র ২হাজার টাকা মাসিক বেতন দিতেন। ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা বেতন পান। এই টাকায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে অনেক সময়।

নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি জানান,নিজের এক টুকরো জমিও নেই। শুধু একটা টিমের ঘর আছে। সেটুকুই আমার সব। দীর্ঘ জীবন পেরিয়েও কোনোরকম সম্পদ গড়তে পারেননি।একমাত্র সম্পদ তাঁর মানবিকতা আর মানুষের দোয়া।

আর্থিক কষ্টে বড় হওয়া তাঁর সন্তানরাও আজও সংগ্রামে। দুই ছেলে তাড়াইল সদর বাজারের মুদি দোকানে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই কোথাও।

তিনি বলেন,মানুষের শেষ বিদায়ের পথটিকে সম্মান জানানো, দায়িত্ব নেওয়া, নীরবে সেবা করে যাওয়া,

এসবই যেন তাঁর জীবনের মন্ত্র। টাকা নয় মানুষ, বিবেক, আর পরকালের ভয় তাঁকে তৈরি করেছে এক নীরব মানবিক কর্মী।

তাড়াইলের এই মানুষটি আলোচিত নন, পরিচিত নন কিন্তু শামছুদ্দিন মিয়া হয়ে উঠেছেন কবরস্থানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাত,হাজারো মানুষের শেষ যাত্রার নীরব সঙ্গী।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X