

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


খেয়াঘাটের মাঝি হিসেবে মালামাল ও যাত্রী পরিবহন করে আসছিলেন তারা বাপ-দাদার আমল থেকে। দিন-রাত নৌকা বেয়ে যা পেতেন তা দিয়ে চলত পরিবারের ভরণপোষণ। কিন্তু নাব্যতা সংকট ও ভাঙনে তিস্তার বুকে পলি জমে নতুন নতুন চর জেগে ওঠায় বন্ধ হয়েছে নৌ চলাচল। ফলে পরিবারের ভরণপোষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুর ঘাটের মাঝিদের।
জানা যায়, উপজেলার হরিপুর ও চিলমারীর দুই পাড়ের লাখ লাখ মানুষের তিস্তা নদী পারাপারের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে অপেক্ষা করতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। রাত ৮টার মধ্যে নৌকা ধরতে না পারলে ভোগান্তি বাড়তো আরো বেশি।
অবশেষে যুগযুগ ধরে চলে আসা সেই বিড়ম্বনার অবসান ঘটে গত ২০ আগস্ট। খুলে দেওয়া হয় দুই পারের লাখ লাখ মানুষের কাঙ্খিত 'মওলানা ভাসানী সেতু।' এবার কপাল খোলে সেতুর আশপাশের মানুষের। ম্যাজিকের মতো গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। ঘুরে দাঁড়ায় অর্থনীতির চাকা এবং চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমানে লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
কিন্তু, মুখ থুবড়ে পড়ে অর্থনীতিবিদ ভিলফ্রেডো প্যারেটোর সেই কল্যাণ অর্থনীতির ধারণা। সেতুর কল্যাণে অনেকেই খুশি হলেও নৌকার মাঝিরা পরিবার-পরিজন নিয়ে পড়েন দুশ্চিন্তায়। বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে যুগের পর যুগ নৌকায় যাত্রী ও মালামাল পারাপার করছিলেন তারা। কিন্তু সেতু উদ্বোধনের পর বন্ধ হয়ে যায় খেয়াঘাট। তবুও তাদের আশা জাগিয়ে রেখেছিলেন দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা। শখের বসে নৌকায় উঠে সেতুর আশপাশে ঘুরতেন তারা। বিনিময়ে যা দিতেন তা দিয়ে টানাটানি করে চলতেন মাঝিরা। কিন্তু পানিশূন্য তিস্তা তাদের সেই আশায়ও ঢেলে দেয় গুড়ে বালি। তিস্তার বুকে পলি পড়ে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল চর। মাটির বুকে লেগে আছে মাঝিদের রুটিরুজির সেই নৌকাগুলো। জেগে ওঠা চর আর সেতুর দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, পরিবারের ভরণপোষণ চলবে কীভাবে?
সরেজমিনে দেখা গেছে, পানি না থাকায় চিরচেনা তিস্তা যেন হারিয়েছে তার রূপ ও যৌবন। কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও বা কোমর সমান। পুরোনো চরের পাশাপাশি জেগে উঠেছে নতুন নতুন চর। চারদিকে চর জেগে ওঠায় বন্দী হয়ে পড়েছে নৌকাগুলো। সেই নৌকার সাথে যেন বন্দী হয়ে পড়েছে ওই ঘাটের ২০-২৫ জন মাঝির জীবন-জীবিকাও। তাদের ভাষ্য, বাপ-দাদার পেশাকে বেছে নিয়ে কী ভুলটাই না করেছিলাম আমরা! অন্য কাজ না জানায় এখন তার মাশুল গুণছেন তারা। ভুগছেন মানসিক বিষণ্নতায়।
নৌকা চালিয়ে বউ, বাচ্চাসহ পরিবারকে বাঁচাতেন জানিয়ে দুলাল নামের এক মাঝি বলেন, ব্রিজের কারণে এখন আর দুই টাকাও রোজগার করতে পারছেন না তিনি, যা দিয়ে বউ, বাচ্চাকে বাঁচাবেন। কী করবেন- এখন সেই উপায় আর খুঁজে পাচ্ছেন না দুলাল।
বাপ-দাদার আমল থেকে নিজেও নৌকায় যাত্রী এবং মালামাল পারাপার করে আসছিলেন আমজাদ। তিনি বলেন, যখন ন্যাংটি পরে বেড়াতাম ঠিক তখন থেকেই নৌকা চালাই। হঠাৎ করে ব্রিজ এবং চর জেগে ওঠায় এখন কী করে খাই? কোনো বুদ্ধি নাই। অন্য কোনো কাজও তো করতে পারি না। আমরা এখন 'ঘাটের মরা।'
২৫-৩০ বছর ধরে নৌকা চালিয়ে এসে এখন বেকার জানিয়ে মিয়া নামের আর এক বৃদ্ধ মাঝি বলেন, সেতুর আগে নৌকা চালিয়ে জীবন চলতো। সেতু চালুর পরেও নদীতে পানি থাকায় দর্শনার্থীদের নিয়ে ঘুরতেন তিনি। যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার চলতো কোনোমত। এখন কীভাবে চলবেন, তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।
নতুন চর ও সেতুর প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়া ঘাটের মাঝিদের জীবন-জীবিকার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফফাত জাহান তুলি।
মন্তব্য করুন
