

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


এক সময় জীবনের উৎস ছিল নদী; আজ সেই নদীই হয়ে উঠেছে ভাঙনের অশ্রুর কারণে আতঙ্কের মূল।
জামালপুর জেলার তিনটি উপজেলা বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ এই দুই নদীর, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা, তীর ঘেঁষে বসবাস করলেও বর্তমানে তারা এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়েছে। বসতভিটা হারিয়ে পড়ছে জনসংখ্যা, ফসলি জমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, স্কুল-মাদ্রাসার পথ আক্রান্ত হচ্ছে।
বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নের ভাটি কলকিহারা গ্রাম। একদিনে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে এই গ্রাম। ভাটি কলকিহারা ও উজান কলকিহারা থেকে কাউনের চর, ঘুঘড়াকান্দি, মাদারচর নদীর তীর মুঠোয় এসে যেন বলছে, “আমরা এখানে নেই।”
মাইলের পর মাইল জুড়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর অবিরাম ভাঙনে শতশত একর ফসলি জমি হারিয়েছে সঠিক তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নিয়ে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে বড় ধরণের ভাঙন ঘটে চলেছে।
লুৎফরগঞ্জ বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গৃহ সবই ধ্বংসের প্রান্তে। “ব্রহ্মপুত্র একসময় আমাদের থেকে কয়েক মাইল দূরে ছিল এখন ঘরের দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে,” বলছেন মতিন মিয়া। এ প্রশ্ন উঠছে মাস্টার প্ল্যান হয়েও কি আর কার্যকর হচ্ছে না? দশকের পর দশক ধরে অপরিকল্পিত মেরামত করা হলেও ভাঙন যেন থামছে না।
ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলী ইউনিয়নের কাটাখালি নদীর শাখায় হঠাৎ ভাঙনের বঙ্গে পড়েছে গ্রাম। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তিন কিলোমিটার জুড়ে নদীর পাড় ধ্বংসের ছায়ায়। “ভাঙনে আমার তিন বিঘা জমি আর বাড়ির অর্ধেক নদীতে চলে গেছে,” বলছেন কৃষক বেলাল।
শিক্ষক আমিনুল ইসলাম জানান, “প্রতি বছরই ভাঙনের ভয় থাকত, কিন্তু এবার তো হঠাৎ করেই এসে পড়েছে।” আরেক গ্রামীণ বাসিন্দার কথা, “আমার ফসলি জমি, ঘরবাড়ি—সবই নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি করব?”
স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের মতে, বালুবস্তা ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন রয়ে যায় -এ কখন বাস্তবায়িত হবে? সময় কি আরও দেওয়া যাবে?
দেওয়ানগঞ্জে যমুনা নদীর বাম তীর বরাবর চরাঞ্চলে ভাঙনের আগুন জ্বলে। চর আমখাওয়া থেকে দহপাড়া, চুকাইবাড়ী, বেলগাছা—এই এক-এক গ্রাম এখন নদীর মুখে দাঁড়িয়ে। “হয়তো কখনও পুরনো গ্রামটা ফিরে দেখা যাবে না,” বলছেন আলতাফুর রহমান।
নদী শুধু জমি নিচ্ছে না এক সঙ্গে নিচ্ছে ইতিহাস, আত্মা, স্মৃতি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে তারা পর্যবেক্ষণ করছেন কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন প্রতিক্রিয়া খুব দেরিতে। এখানে মানুষের প্রশ্ন একটাই “কখন পর্যন্ত অপেক্ষা?”
এই তিন উপজেলায় মূল চিত্র প্রায় একই “নদী ভাঙছে, তলিয়ে যাচ্ছে গ্রাম।” ভাঙনের কারণ হিসেবে রয়েছে: তীরবর্তী গাছপালা ধ্বংস, বালু উত্তোলন, শ্যালো তীর, নদীর অনিয়ন্ত্রিত গতিপথ। গবেষণা বলছে যমুনা এবং ব্রহ্মপুত্র–যমুনা চ্যানেলের ভাঙন গত শতকে অত্যন্ত বেশি।
স্থানীয়দের দাবিটা স্পষ্ট টেকসই বাঁধ নির্মাণ, নদী-তীর পুনর্বাসন, প্রতিরোধ কাঠামোর অবিলম্বে বাস্তবায়ন। সরকারি কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে; পর্যবেক্ষণ চলছে। কিন্তু এখানে গতি দরকার, নয়তো এই অঞ্চল হবে মানববিহীন।
বকশীগঞ্জের ভাটি কলকিহারা, ইসলামপুরের কাটাখালি ও দেওয়ানগঞ্জের চরাঞ্চল এই তিন জায়গায় নদী যেন এক বিশাল বুলডোজার হয়ে বসেছে। ঘরবাড়ি, জমি, স্কুল, মসজিদ সবই এক-এক করে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
এখানে শুধু ভাঙন নয় ভাঙনের মধ্য দিয়ে চলছে একটি জীবনের গল্প: প্রতিদিনের আশা, প্রতিদিনের ভয়। সেই ভয় যেন একটি ওড়া শীতের রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো নীরব কিন্তু ভয়ঙ্কর। এবার সময় এসেছে শুধু ছবি দেখিয়ে শেষ করার নয়; পরিকল্পনা দিয়ে, বাস্তবায়ন দিয়ে রেসপন্স দেখানোর। কারণ এই ত্রয়ী উপজেলায় শুধুই নদী ভাঙছে না ভাঙছে মানুষ নিজেই।
মন্তব্য করুন