

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


বাংলার মৃৎশিল্প শুধু একটি পেশা নয়,এটি আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও নান্দনিকতার প্রতীক। একসময় গ্রামীণ জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ ছিল মাটির তৈরী হাঁড়ি, পাতিল,কলস,থালা,টোপা,ধুপদানী,প্রদীপ, খেলনা, ফুলদানী সহ প্রভৃতি তৈজসপত্র।কিন্তু আধুনিকতা ও প্লাস্টিকের দৌড়ে সেই শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এমনই এক জনপদ শিবচরের ভদ্রাসন ইউনিয়নের উত্তর ও দক্ষিণ পাল পাড়া, যেখানে একসময় প্রতিটি উঠানে ঘুরত মাটির চাকা। হাঁড়ি - কলস বানানোর টুংটাং শব্দে ভরে থাকতো গ্রামের সকাল। কিন্তু এখন আর পুরোনো জৌলুশ নেই। ফলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভদ্রাসনের উত্তর ও দক্ষিণ পাল পাড়ায় শতাধিক পাল পরিবারের বসবাস এবং তাদের সবার পেশা ছিল মৃৎশিল্প। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ টি পরিবার। আর যারা জড়িত আছেন তাদের মাঝেও হতাশার সুর। যেন অনেকটা বাধ্য হয়েই টিকে আছেন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই পেশায়। অনেকের বাড়ীতে তৈজসপত্র বানানোর সরঞ্জাম দেখা গেলেও তা পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়।
জাত ব্যবসার প্রতি কেন এই অবহেলা? এমন প্রশ্নের জবাবে কালিপদ পাল (৮০) বলেন, "আগে প্রতিটি ঘরে মাটির তৈরী তৈজসপত্র ব্যবহার করা হতো। কিন্তু যুগের স্রোতে এর বিকল্প হিসেবে ক্ষতিকর প্লাস্টিক, সিলভার ও মেলামাইনের পণ্য ব্যবহার করায় মাটির তৈরী তৈজসপত্রের ব্যবহার কমে গেছে। ফলে আমাদের পণ্যের চাহিদা ও কমে গেছে। বিধায় আমাদের অনেকের বাড়ীতেই এই গুলো কালের স্বাক্ষী হয়ে পড়ে আছে। এমতাবস্থায়, এগুলোকে সচল করে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বান্ধব শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের নিকট জোর দাবী জানাচ্ছি।"
দক্ষিণ পাড়ার বিমল পাল (৬০) ও কৃষ্ণ পাল(৫৫) বলেন, "আদিকাল থেকেই আমাদের বাব - দাদারা এই শিল্পে করিৎকর্মা। তাদের হাত ধরেই আমাদের এই শিল্পে পদার্পণ। আমরা গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত সকল তৈজসপত্রই তৈরী করি। কিন্তু বর্তমানে এই পেশায় টিকে থাকাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ এই শিল্পের মূল উপাদান বাছাইকৃত মাটি সহ সকল উপাদানের দাম বেড়ে গেছে। আর প্লাস্টিক, সিলভার ও মেলামাইনের পণ্যের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে এর চাহিদাও কমে গেছে। বিধায় অনেকটা অভিমানের সুরে বলেন,বাপ-দাদার পেশাকে আমরা ধরে রাখলেও আমাদের সন্তানদেরকে এই পেশায় রাখব না।"
উত্তর পাড়ার পান্নাত পাল (৬৫) বলেন, "প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবত আমি এই শিল্পের সাথে জড়িত। আর আমি আম,কাঁঠাল, তাল,বেল,কলা,লিচু, আপেল প্রভৃতি তৈরী করে থাকি। কিন্তু এখন প্লাস্টিক খেলনার আধিক্যের কারণে মাটির তৈরী এই পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না যে,প্লাস্টিক মানব দেহের ক্ষতি করলেও মাটি কোন ক্ষতি করে না। তাই যে কোন উপায়ে এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানাচ্ছি। "
স্হানীয় ব্যাবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জামাল খালাসী (৫০) বলেন, "আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন এই এলাকায় মাটির তৈরী তৈজসপত্র পোড়ানোর ধোঁয়ায় চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়ত।আর পোড়া মাটির তৈজসপত্রের টুংটাং শব্দে একটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। কিন্তু ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্যের প্রভাবে এখন তা নিভু নিভু অবস্থা। তাই এই প্রাচীন পরিবেশ বান্ধব শিল্পটিকে আবার জাগিয়ে তোলা দরকার। আর এই জন্য প্রয়োজন সরকারি, বেসরকারি ও সমাজের সচেতন মানুষের সমন্বিত উদ্যোগ।"
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহসান হাবিব বলেন, " মাটির তৈরী তৈজসপত্র মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই অত্যন্ত উপকারী। এটি শুধু ঐতিহ্য নয়; বরং পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই জীবন ধারার প্রতীক। এতে কোন রাসায়নিক বা বিষাক্ত পদার্থ নেই। ফলে এসব পাত্রে রান্না বা সংরক্ষণ নিরাপদ এবং পুষ্টিগুন অক্ষুণ্ণ থাকে। তাই যেকোন মূল্যে এই শিল্পের প্রসারণ ঘটাতে হবে। "
বিসিক, মাদারীপুরের সহকারী মহাব্যবস্হাপক মো.জালিস মাহমুদ বলেন, "আমি মাদারীপুরে নতুন এসেছি, বিধায় এই ব্যাপারে এখনো কিছু জানিনা। তবে শীঘ্রই আমি উল্লেখিত এলাকায় পরিদর্শনে যাব এবং পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করব।"
এই ব্যাপারে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম ইবনে মিজান বলেন,মৃৎশিল্প আমাদের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প,যা বাংলার সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। ভদ্রাসনের পাল পাড়ার বিলুপ্ত প্রায় মৃৎশিল্পকে পুনর্জীবিত করতে আমরা কারিগরদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে কাজ করব।
মন্তব্য করুন