

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


চলনবিল অধ্যুষিত উল্লাপাড়ার পংখারুয়া গ্রাম—চারদিকে জল আর কাদার রাজত্ব। বর্ষাকালে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা, আর শুষ্ক মৌসুমেও চলাচল করতে হয় ভাঙাচোরা কাঁচা পথে।
এমন দুর্গম অঞ্চলের মাঝেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে পংখারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
১৯৬৮ সালে আলহাজ ময়ান উদ্দিনের দানকৃত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি। শুরুটা হয়েছিল ছনের ঘরে কয়েকজন শিক্ষক ও হাতে গোনা ছাত্রছাত্রী নিয়ে। সেই সময় শিক্ষকরা নিজেরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করতেন।
বর্ষার দিনে শিক্ষার্থীরা কখনও কলার ভেলা, কখনও ছোট নৌকা, আবার কখনও স্টিলের পাতিল ভাসিয়ে স্কুলে আসত—এমন ছিল তাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা।
সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে বিদ্যালয়ের চেহারা। এখন এখানে রয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, আইসিটি ব্যবহারের সুযোগ, সততা স্টোর, স্কাউট কার্যক্রম, শরীরচর্চা, খেলাধুলা, এমনকি বার্ষিক বনভোজনও।
বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা দেখে যে কেউ বলবে—এটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী হুসনেয়ারা খাতুন জানায়, “মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে পড়তে অনেক ভালো লাগে। ছবি, কবিতা, গল্প দেখে শিখতে পারি। শুধু শিক্ষক সংকট না থাকলে আরও ভালো হতো।”
আরেক শিক্ষার্থী বলে, “বৃষ্টি হলে স্কুলে যেতে কষ্ট হয়। রাস্তা কাদা হয়ে যায়, ড্রেস ময়লা হয়। ভালো রাস্তা হলে আমরা সহজে যেতে পারতাম।”
সহকারী শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান অনেক সহজ হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা এখন আরও আগ্রহীভাবে শিখছে—খেলাধুলার মধ্য দিয়েই তারা শেখার আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে।”
বিদ্যালয়ের সুনাম এখন আশপাশের স্কুলগুলোতেও আলোচনার বিষয়। হেমন্তবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সোহেল রানা বলেন, “এত প্রত্যন্ত এলাকায় এমন সুন্দর পরিবেশ বিরল। শিক্ষকের উপস্থিতি না থাকলেও শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে ক্লাসে থাকে—এটা সত্যিই প্রশংসনীয়।”
বনবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহানারা খাতুন বলেন, “অ্যাসেম্বলিতে শিক্ষার্থীদের সারিবদ্ধতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এখান থেকে শৃঙ্খলার পাঠ নিয়েছি, যা নিজের বিদ্যালয়েও বাস্তবায়ন করতে চাই।”
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কে. এম. রহমতুল বারী জানান, “আগে শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৫০ জন, এখন তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে এই বিদ্যালয় আরও এগিয়ে যাবে।”
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, “রাস্তাটি বর্তমানে বেশ নাজুক অবস্থায় আছে। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব যেন দ্রুত সংস্কার করা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই বিদ্যালয়টি অন্যদের জন্য এক অনুকরণীয় উদাহরণ।”
বর্তমানে সাতজন শিক্ষকের স্থলে মাত্র চারজন শিক্ষক দিয়ে চলছে বিদ্যালয়টি। তবুও তাদের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে শিক্ষার মান তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত। এর স্বীকৃতিস্বরূপ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন।
অসংখ্য প্রতিকূলতার মাঝেও বিলের বুক চিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পংখারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়—প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের স্বপ্নের দিশারী, আলোকিত আগামীর প্রতীক।
মন্তব্য করুন