


যমুনা নদীর ভাঙন কবলিত সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার শিমুলদাইড় বাজার এখন বাংলাদেশের কম্বল শিল্প নামে পরিচিত। পোশাক কারখানার পরিত্যক্ত টুকরো ঝুট কাপড় দিয়ে এখানে তৈরি হচ্ছে হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের শীত নিবারণের কম্বল। প্রায় তিন দশকের বেশী সময় ধরে চলে আসা কম্বল তৈরির কাজটি এ অঞ্চলে এখন শিল্পের খ্যাতি লাভ করেছে। আর এসব কম্বল কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ ছাড়াও সারাদেশের হতদরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের অন্যতম বস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই এ বছরও শীতের আগমনিতে সরগরম হয়ে উঠেছে কাজিপুরের কম্বল পল্লির গ্রামগুলো। জেলার কাজিপুর উপজেলার শিমুলদাইড়, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, ঢেকুরিয়া ও বেলতৈল সহ আশপাশের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ টি গ্রামের প্রতিটি ঘরেই চলছে সেলাইয়ের কাজ।গ্রামের নারীরা এখন আর বসে নেই তারাও কম্বল সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিদিন সকাল থেকেই জমজমাট থাকে কম্বলের বাজার খ্যাত কাজীপুর উপজেলার শিমুলদাইড় বাজার। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ী ও পাইকার এখানে আসেন, কিনে নিয়ে যান নানা রঙের কম্বল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এবার চলতি মৌসুমে ৮০ থেকে ৯০ লাখ পিস কম্বল তৈরির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এখানকার কারিগরদের। এতে এ বছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। এরই মধ্যে ২০ থেকে ২৫ লাখ কম্বল বিক্রি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।তবে সময়ের ব্যবধানে এ কাজে যুক্ত হয়েছে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ৫০ গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। ফলে কম্বল তৈরি ব্যবসায় স্বাবলম্বী হচ্ছে গ্রামীন নারীরা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে বেকার যুবকদের।
এ বিষয়ে কথা হয় উপজেলার ছালাভরা গ্রামের তাসলিমা খাতুনের সাথে তিনি জানান, শিমুলদাইড় বাজার থেকে ঝুট কাপড় কিনে নিয়ে গিয়ে সেলাই করে কম্বর তৈরি করেন তিনি। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কম্বল সেলাই করে প্রত্যেক মাসে তিনি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বাড়তি আয় করেন। যার ফলে তার সংসারে আগের চেয়ে অনেক আয় উন্নতি হয়েছে। একই গ্রামের আরেকজন ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা রিনা আক্তার বলেন, এখানে কম্বল ব্যবসা গড়ে উঠার কারণে অত্র এলাকায় ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এতে করে পরিবারগুলো আগের চেয়ে অনেকটা স্বাবলম্বী হচ্ছে। সরকার যদি কম সুদে লোনের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে এ ব্যবসাটা আরো ভালোভাবে চালাতে পারতাম।
শিমুলদাইড় বাজারে কম্বল ব্যবসায়ী ফরহাদ রেজা বলেন, কম্বল তৈরি ব্যবসা এখন আগের চেয়ে অনেক পরিসর বেড়েছে ব্যবসাও ডিজিটালেশন হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম ও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে পেজ খুলে সারাদেশে গ্রাহকদের দোড়গড়ায় কম্বল পোঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছি। এতে করে গ্রাহকদের যেমন হয়রানি ও ভোগান্তি কমেছে তেমনি বিশ্বাস্ততা বেড়েছে। কম্বল ব্যবসার কারণে এখানকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তেমনিভাবে শিক্ষার্থীরাও এ কাজে অংশগ্রহন করে তাদের লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করতে সক্ষম হচ্ছে ও সেই সাথে আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছে।
শিমুলদাইড় বাজারে পুরানো কম্বল ব্যবসায়ী বদিউজ্জামান বলেন, এ বাজারে কম্বলের শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকান থেকে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অনেক জেলায় কম্বল সরবরাহ করা হচ্ছে। ক্রেতারা পছন্দ করে দরদাম ঠিক করে টাকা পাঠালে এখান থেকে ট্রাকে কম্বল পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিদিনই ট্রাকে করে কম্বল যাচ্ছে বিভিন্ন জেলায়। মৌসুমের শুরুতেই প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকার কম্বল বিক্রির অর্ডার পাচ্ছেন তিনি। এ থেকে প্রতিদিন তিনি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করছেন। এ মৌসুমে তিনি ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার কম্বল বিক্রি করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
কম্বল ব্যবসায়ী লিটন সরকার বলেন,গার্মেন্টস থেকে আনা ঝুট কাপড় দিয়ে বাহারি রকমের কম্বল তৈরী করে স্বাবলম্বী হয়েছেন এই এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। মানে ভালো আর দামে কম হওয়ায় এখানকার কম্বলের চাহিদা রয়েছে সারাদেশ জুড়ে। স্বল্প সুদে ঋণ সহ ব্যাংকের শাখা স্থাপন করলে এই শিল্পের আরো উন্নয়ন হবে মনে করেন তিনি।
শাহজাদপুর থেকে কম্বল কিনতে আসা আসিকুর রহমান বলেন, শীত এলেই গরীব মানুষের কাছে কাজীপুরের ঝুঁট কাপড়ের কম্বলের কদর বেড়ে যায়। দামে কম, টেকসই আর ভালো ওম পাওয়া যায় বলে এ কম্বলের চাহিদা বেশি। তাই এখান থেকে কম্বল কিনে নিয়ে এলাকায় আমরা সীমিত লাভে বিক্রি করে থাকি। এখানকার কম্বলের চাহিদা রয়েছে প্রতিটি এলাকায়। তাই তো এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা কম্বল ক্রয় করতে আসে । শিমুলদাইড় কম্বল বাজার সমিতির সভাপতি গোলাম হোসেন বলেন, এ সমিতির আওতায় ৩০৭ জন সদস্য রয়েছেন। প্রত্যেকেই ছোট-বড় কম্বল ব্যবসায়ী। এ মৌসুমে ৮০ থেকে ৯০ লাখ পিস কম্বল তৈরি করে বিক্রি করা হবে। এতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, কাজীপুর উপজেলার শিমুলদাইড় বাজারের কম্বল ব্যবসার সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।এখানকার কম্বলগুলো দামে কম, মানেও অনেক ভালো। সেখানে বিভিন্ন ধরনের কম্বল পাওয়া যায়। তাই তো প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসার হয় সেখানে। কাজিপুরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাড়াতে এবং এই শিল্পটিকে প্রসারের জন্য, স্বল্প সুদে ঋণ ও ব্যাংক স্থাপনসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর জন্য সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যমুনা নদীর ভাঙনে প্রায় নিঃস্ব নারী-পুরুষেরা কম্বল তৈরির কাজ করে অনেকটাই সচ্ছল হচ্ছেন। আমরা কম্বল ব্যবসায়ীদের পাশে সব সময় রয়েছি। ছোট্ট পরিসরে শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপি জনপ্রিয়তা পাওয়ায় প্রসার ঘটতে থাকে এই কম্বল শিল্পের। প্রতি শীত মৌসুমে এই এলাকাগুলো থেকে সারাদেশে প্রায় কোটি কোটি টাকার কম্বল বিক্রি করা হয়। পাইকারদের কাছে সরাসরি বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনেও সারাদেশেই বিক্রি হচ্ছে এখানকার কম্বল। এ ব্যবসার পরিসর বাড়ানোর জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মন্তব্য করুন