রবিবার
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রবিবার
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফসলি জমিতে ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় অসুস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা 

এস এম মিজানুর রহমান মজনু, ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:০১ এএম
ইটভাটা
expand
ইটভাটা

ময়মনসিংহের ভালুকায় আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি পাকা সড়কের পাশে ও ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৮টি ইটভাটা। এসব ইটভাটায় সামাজিক বনায়নের কাঠ এনে ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ফলে আশপাশের কৃষি আবাদী জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। আর ইটভাটার কালো ধোঁয়া উড়ে আসা ধুলাবালিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়ার মতো না হলেও রহস্যজনক কারণে বেশ কয়েটিতে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনের তেমন তৎপরতা নেই। ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে ফসলি জমি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার ধীতপুর ইউনিয়নের ধলিয়া পলাশতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তরপাশ ঘেঁষে আনিছুর রহমানের রিফাত ব্রিক্স, সোহাগ খানের আলসাফা ও জালাল উদ্দিনের সেবা নামক লাইসেন্স বিহিন তিনটি ইটভাটা।

আনিছুর রহমানের রিফাত ইটভাটার চারপাশে মজুদ করে রাখা হয়েছে কয়েকশ মন লাকড়ি। চিমনি দিয়ে প্রচন্ড বেগে বের হচ্ছে ধোঁয়া।

আর সেই ধোঁয়া পাশের ওই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা ২শ শতাধিক কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ আশপাশের বসতি ও ফসলের ব্যাপকভাবে ক্ষতি হচ্ছে।

এছাড়াও মেদুয়ারী গ্রামে অবস্থিত জাহিদ ব্রিক্স, বহুলী গ্রামে মিরাজ ব্রিকস, মেদিলা বাহির পাথার খোরশেদ আলমের আলম ব্রিক্স, উরাহাটি গ্রামে সুরুজ তালুকদারের (টিএলআ ব্রিক্স) ইটভাটায় বিপুল পরিমাণ কাঠ মওজুদ অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে, উপজেলার শান্তিগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত দীপ্তি একাডেমি উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে ও শান্তিগঞ্জ-ধলীয়া পাকা রাস্তা ঘেঁষে ইয়াসিনের এমবিবি ও সুলতান মিয়ার এম আর এল ব্রিক্স গড়ে উঠেছে।

এদিকে, সরকারি কার্পেটিং সড়কের ৫শ মিটারের ভেতর ভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ হলেও মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের ভায়াবহ গ্রামে ভালুকা টু সখিপুর সড়ক ঘেঁষে, আবাসিক ও ফসলি জমিতে ফোকাস অটো ব্রিক্স নামে একটি ইটভাটা পরিচালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ইটভাটায় শিশু ও নারী শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়ে থাকে। এমনকি ইট তৈরিতে ৬ থেকে ৭ ধরণের ডাইস ব্যবহার করা হয় এবং ইটের সাইজ ছোট-বড় করে প্রতিনিয়তই ক্রেতাদের সাথে প্রতারণা করা হয়ে থাকে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা হয়েছে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির অর্থাৎ জিগজ্যাগ ক্লিন, হাইব্রিড হফম্যান ক্লিন, বার্টিক্যাল শফট ক্লিন, টানেল ক্লিন বা অনুরুপ উন্নততর প্রযুক্তির পরিবেশ বান্ধব ইটভাটা স্থাপন করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে, আবাসিক ও জনবসতি, সংরক্ষিত এলাকার বনভূমি এবং জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা করা যাবে না, সরকারি বনাঞ্চলের সীমারেখা হতে দুই কিলোমিটার দুরত্বে করতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর হতে ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন বা লাইসেন্স না নিয়ে ইটভাটা চালু করা যাবে না। এ আইন অমান্য করলে কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।

আর এসব ইটভাটা তদারকি করার জন্য জেলা প্রশাসকের নির্দেশে স্থানীয় বন-বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান থাকলেও তাদের রহস্যজনক নিরবতার কারণে ভালুকার অধিকাংশ ইটভাটা মালিক এসব আইনের তোয়াক্কা না করে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ফসলি জমির টপসয়েল ব্যবহার করে দেধার তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে আশপাশ এলাকার আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস ও বিভিন্ন প্রজাতীয় ফলজ, বনজ গাছপালা সহ প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছে, ফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপনা একটি সমস্যা, যা পরিবেশ, কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি, কারণ এতে মূল্যবান কৃষি জমি নষ্ট হয়, মাটি ক্ষয় হয়, বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়ায় এবং ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্থানীয় আইন ও পরিবেশগত নিয়মকে লঙ্ঘন করে। ফলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপন বেআইনি, পরিবেশ ও কৃষির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কারণ। এতে উর্বর মাটি কেটে নেওয়া হয়, ধোঁয়ায় ফসল নষ্ট হয় ও রোগ ছড়ায় এবং পরিবেশ দূষণ হয়। আইন থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে অনেক ইটভাটা চলছে যা বন্ধ করা জরুরি তাদের মতে।

ধীতপুর ইউনিয়নের পলাশতলী গ্রামের স্থানীয়রা জানান, ইট পোড়ানোর কারণে সৃষ্ট কালো ধোঁয়া এবং উড়ে আসা ধুলাবালিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর নষ্ট হচ্ছে বিদ্যালয়ের পাঠদানের পরিবেশ। এছাড়া ইট ভাটার বিরুপ প্রভাবে আশপাশের এলাকায় ফলজ ও সবজিসহ কোনো ধরণের ফসলাদি ফলানো সম্ভব হচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ইটভাটা মালিক জানান, ভালুকার কোন ভাটারই হালনাগাদ লাইসেন্স নবায়ন নেই। কিভাবে চলে প্রশ্ন করা হলে তারা জানান, প্রতিটি ইটভাটা থেকে ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসক ও বনবিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টর ম্যানেজ করে থাকেন উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির নেতারা।

রাজৈ ইউনিয়নের উরাহাটি মধুনী পাথারে গড়ে উঠা এম এম আর ব্রিক্সের মালিক মনো মিয়া জানান, ইউএনওসহ প্রশাসনের কর্মকর্তা ব্যক্তিরা তার ভাটা পরিদর্শন করে গেছেন এবং পরিবেশ থেকে ছাড়পত্রও দেয়া হয়েছে।

ভালুকা এমবিসি ভাটার মালিক ও ইটভাটার সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান সবুজ জানান, কয়টা ভাটা আছে বা কতোটার কাগজ ঠিক আছে, তা তার জানা নেই। এছাড়া এসব তথ্য আমাদের একান্তই অভ্যন্তরীন বিষয়।

এ ব্যাপারে উপজেলা ইটভাটা তদারকি কমিটির সদস্য ভালুকা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা সাদিকুজ্জামান জানান, তাকে কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হলেও, তাকে কোন সময়ই ডাকা হয়নি। তাই তিনি এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারছেন না।

এ বিষয়ে ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ইটভাটা তদারকি কমিটির সদস্য মো. ফিরোজ হোসেন জানান, তিনি নতুন যোগদান করেছেন, খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে, যে সকল ভাটায় অনিয়ম পাওয়া যাবে বা লাকড়ি পোড়ানো হয়ে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ওই নির্বাহী কর্মকর্তা।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X