

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেসব ব্যক্তিত্ব আপসহীনতা, দৃঢ়তা ও দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে পৌঁছানোর এই পথচলা ছিল চড়াই-উতরাই, ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনে ভরা।
খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের জলপাইগুড়িতে। ১৯৬০ সালে কলেজপড়ুয়া অবস্থায় তাঁর সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার জিয়াউর রহমান-এর বিয়ে হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো নয় মাস তিনি দুই সন্তানসহ গৃহবন্দি অবস্থায় কাটান।
রাজনীতিতে প্রবেশের প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার সংহতি ও বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে তিনি নিহত হন।
সেই সময় খালেদা জিয়া ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। দুই সন্তান নিয়ে তিনি ঢাকা সেনানিবাসে বসবাস করছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। দলকে কে নেতৃত্ব দেবেন তা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা।
বিএনপিতে যোগদান ও নেতৃত্বে উত্তরণ
১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে যোগ দেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্ব দলের ভেতরে প্রশংসা কুড়ায়। একই বছরের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দলের ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে আমাকে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তাই বৃহত্তর স্বার্থে আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি।”
বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থ হলে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হন এবং একই বছরের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৩, ২০০৯ ও ২০১৬ সালে ধারাবাহিকভাবে তিনি চারবার বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও আপসহীন নেতৃত্ব
দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরই খালেদা জিয়া সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ-এর বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলন গড়ে তোলেন। কোনো ধরনের সমঝোতা না করে ‘এরশাদ হটাও’ একদফা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন ঘটে।
এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হন-
১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর
১৯৮৪ সালের ৩ মে
১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে খালেদা জিয়া প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে জোট সরকার গঠন করে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
তিনি দুইবার দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনী ইতিহাসে তাঁর একটি অনন্য রেকর্ড রয়েছে- পাঁচটি জাতীয় নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই জয়ী হন।
গ্রেপ্তার, মামলা ও নির্যাতনের অধ্যায়
২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাবাসকালে তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর তাকে সেনানিবাসের বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সেখানে তিনি টানা ২৮ বছর বসবাস করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, বলপ্রয়োগে তাকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
পরবর্তী সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়। বিএনপির অভিযোগ ছিল, কারাগারে তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে ‘স্লো পয়জনিং’ করা হয়েছে।
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার দাবি জানানো হলেও দীর্ঘদিন সরকার এতে সাড়া দেয়নি। সর্বশেষ সরকার পরিবর্তনের পর ২০২৫ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দেন। একই বছরের ২৭ নভেম্বর তিনি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালাস পান।
আপসহীনতার প্রতীক
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্যাতন, কারাবাস, মামলা ও রাজনৈতিক চাপের মুখেও তিনি কখনো আপস করেননি। এই আপসহীনতা তাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্বতন্ত্র ও শক্ত অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
গৃহবধূ থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্ব খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন তাই কেবল ক্ষমতার নয়, বরং সংগ্রাম, দৃঢ়তা ও ইতিহাস নির্মাণের এক দীর্ঘ অধ্যায়।
মন্তব্য করুন

