মঙ্গলবার
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মঙ্গলবার
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিক্ষার্থীর ভাবনায় বিজয় দিবস: ইতিহাস থেকে ভবিষ্যতের অঙ্গীকার

আমির ফয়সাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪০ এএম
ফাইল ছবি
expand
ফাইল ছবি

ডিসেম্বর এলেই বিজয়ের স্মৃতি ফিরে আসে পতাকা, গান আর আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে। কিন্তু ৫৪ বছর পর বিজয় দিবস কি কেবল একটি তারিখ, নাকি এখনও এটি জীবিত কোনো চেতনা?

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় বিজয় দিবস আজ আর শুধু ১৯৭১-এর স্মৃতি নয় এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন এবং স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ খোঁজার এক চলমান লড়াই।

শিক্ষার্থীদের ভাবনা-

১. "১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে আমাদের বাংলাদেশ।পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর আমরা পাই স্বাধীন একটি ভূখন্ড। কিন্তু বিজয় অর্জন হওয়ার পর আমাদের দেশকে ভারত কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলো।যুগে যুগে ভারতীয় আদিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও আমাদের জীবন দিতে হয়েছে।স্বাধীন দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত এখনো সীমান্তে আমাদের পাখির মতো গুলি করে মারে।

এদেশের মাটি থেকে যেমনি পাক হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করা হয়েছে।তেমনি ভারতীয় আগ্রাসনকে যেদিন বিদায় করতে পারবো আমরা সেদিন আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা স্বাদ পাবো।২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্য দিয়ে আমরা সেটি বুঝিয়ে দিয়েছি,আমরা কোনো আধিপত্যবাদ মানি না।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা নতুন একটি ফ্যাসিবাদ মুক্ত দেশ পেয়েছি।আমরা এটি আজন্ম ধরে রাখবো।দেশের মর্যাদা রক্ষার্থে আমরা স্লোগান তুলেছি,"জন্মভূমি অথবা মৃত্যু "।দেশের আপামর জনতার মুক্তির জন্য আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত। এটি হোক আমাদের বিজয় দিবসের শপথ"

শিক্ষার্থী, আব্দুল কাদের জীবন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

২. "বিজয় দিবস আমাদের কাছে পবিত্র আবেগ এবং শত সহস্র ঘটনায় মোড়ানো একটু ঐতিহাসিক দিন। এই দিনটি বিভিন্ন আঙ্গিকে উদযাপন করার সময় আমরা অনেকেই ভুলে যাই দিনটি তাৎপর্য । বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ায় যেন একদিনের চেতনা । গ্রামের কুঁড়েঘর থেকে শহরের গগনচুম্বী অট্টালিকা সবখানেই যেন শোভা পায় জাতীয় পতাকা।

একটি দিনকে বিজয় দিবসে পরিণত করার আগে , কত ভাইয়ের প্রাণ গিয়েছে কত বোনেদের গগন বিদারী চিৎকারে ভারী হয়েছে বাংলার আকাশ বাতাস।সে কথা কয়জনে বা মনে রাখে.! যে কেবল বিজয় দিবসের স্নিগ্ধতা অনুভব করে , যার কাছে বিজয় দিবস মানে একগুচ্ছ ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি সে বিজয় দিবসের মহত্ব বোঝেনা।

এমন শত সহস্র ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি বিজয় দিবস । সুতরাং শুধু বিজয় দিবস জানলেই হবে না যেই পথ ধরে বিজয় এসেছে সে পথের প্রতিটি বাকে বাকে গড়ে ওঠা সংগ্রাম সম্পর্কেও আমাদের জানতে। বিজয় আসিবার পূর্বে সংগঠিত সকল বিপ্লবের বিপ্লবীদের আজ,বিজয় দিবসের বিনম্র শ্রদ্ধা।"

শিক্ষার্থী, হামিম সিয়াম,ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ,সদরপুর সরকারি কলেজ ।

৩. মহান বিজয় দিবস নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি গৌরবের দিন। ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের দিন। বিজয় দিবসে আমার প্রত্যাশা, সোনার বাংলা হবে এমন এক দেশ যেখানে দারিদ্র্য ও শোষণের কোন স্থান থাকবে না। বিজয় দিবসে আমি শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। পাবলিক -প্রাইভেট -জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেদাভেদের অবসান চাই। আমি চাই বেকারত্বের সমাধান এবং কর্মক্ষেত্রে কোন প্রকার বৈষম্য থাকবে না। আমরা সুশিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও দেশপ্রেমিক প্রজন্ম চাই। যারা হবে সৎ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার।

আমাদের এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায় বিচার। বিজয় দিবস হোক নতুন শপথ নেওয়ার দিন,মানবিক ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ। যার আলোয় আলোকিত হবে আমাদের দেশ।।

শিক্ষার্থী, শিপন খান,একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস , কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

৪. "বিজয় মানে হচ্ছে - জয়, সাফল্য, কোন যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে আত্মঅধিকার অর্জন করা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বর অর্জন করে তাদের বিজয়।শিক্ষার্থীদের কাছে বিজয় দিবস শুধু একটি ছুটির দিন নয়। এটি দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও বিজয়ের গৌরবের প্রতীক। শিক্ষার্থীদের ভাবনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার চেতনার ছড়িয়ে দেওয়া, সমৃদ্ধ দেশ গড়ায় শপথ নেওয়া এবং ইতিহাসকে শুধু বইয়ের পাতায় না রেখে , সারা বছর এর অনুশীলন করা প্রয়োজন।বিজয় দিবসকে কিছু কর্মসূচি বা উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর যথার্থ তাৎপর্য ও উপলব্ধি সকলের মধ্যে সম্প্রসারণ করা জরুরী। কেননা এর উপযুক্ত মর্ম উপলব্ধি করতে না পারলে বিজয়ের মর্যাদা অক্ষুন্ন হবে।

শিক্ষার্থী, পায়েল আক্তার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।

৫. ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তান দীর্ঘ ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এই অবস্থা একসময় প্রতিবাদে রূপ নেয়। ১৯৭১ সালে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে এবং ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে।

এই মহান বিজয়ের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় একটি নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ফিরে পায় তার হারানো সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার এবং বাঁচার মৌলিক অধিকার। বিশ্বের মানচিত্রে গর্বের সঙ্গে ফুটে ওঠে এক টুকরো ‘লাল-সবুজ’ বাংলাদেশ।

-সাজেদুল ইসলাম, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

৬. ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। এক রক্তক্ষয়ী তীব্র সংগ্রাম, কল্পনাতীত আত্মত্যাগ ও অসংখ্য নারী-পুরুষের সম্ভ্রম বিসর্জনের বিনিময়ে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি সে বিজয় আমাদের অস্তিত্বের শেকড়। ২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে সেটা আরও গভীরভাবে অনুভব করতে পারি। একইসাথে এক অদ্ভুত বেদনাও অনুভব করি। কারণ, ১৯৭১ এ অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের আজ ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের তরে বিলিয়ে দেওয়া লাখো শহীদের প্রাণ ও অজস্র নারী-পুরুষের সম্ভ্রমের যথাযথ মূল্যায়ণ আমরা করতে পারিনি। তাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানের মধ্য দিয়েই আমাদের সেই কলঙ্ক দূর করতে হবে। এটা আমাদের জাতিগত দায়বদ্ধতা।

শিক্ষার্থী, হাফিজুর রহমান আরাফাত, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

৭. শিক্ষার্থীদের কাছে বিজয় দিবস শুধু একটি সরকারি ছুটির দিন নয়; এটি ত্যাগ, সংগ্রাম, গৌরব ও জাতীয় আত্মপরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক। এই দিনটি তাদের মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শহীদদের আত্মত্যাগ এবং স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য। বিজয় দিবস শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধকে আরও দৃঢ় করে এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি গর্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

একই সঙ্গে তারা মনে করে, বিজয়ের চেতনা ধারণ করার অর্থ শুধু উদযাপন নয় বরং শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। এই দিনটি তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন প্রত্যাশা ও প্রেরণা জাগায় এবং সামাজিক সম্প্রীতি, দায়িত্ববোধ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানায়। শিক্ষার্থীদের ভাবনায় তাই বিজয় দিবস হলো অতীতের ত্যাগ, বর্তমানের চেতনা ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির এক অনন্য মিলন।

শিক্ষার্থী, আরফিন জাহান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X