


বালিয়াডাঙ্গী ও হরিপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত ঠাকুরগাঁও-২ আসন। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে নৌকার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল।
আসনটিতে দীর্ঘ সাতবারের এমপি দবিরুল ইসলাম প্রথমে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে একবার এবং নৌকা প্রতিকে নির্বাচন করে টানা ছয়বার আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হন।
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতিকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের এমপি হন দবিরুল ইসলামের ছেলে মাজহারুল ইসলাম সুজন।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে দীর্ঘ ৩৫ বছরে বিএনপি-জামায়াত তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারেনি। হামলা-মামলার শিকার হতে হয়েছে বিরোধী দলগুলোকে। আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য থাকার কারণে দীর্ঘদিন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল দবিরুল পরিবার।
তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর উন্মোচিত হয়েছে নতুন দ্বার। আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে পিছিয়ে পড়া রাজনৈতিক দলগুলো। দল-মত নির্বিশেষে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ইতোমধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাই নতুন করে দল গুছাতে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। এরই মধ্যে তারা নিয়েছেন নির্বাচনের প্রস্তুতি। শুরু করেছে নির্বাচনী প্রচারণা, ছুটে বেড়াচ্ছেন গ্রামেগঞ্জে। যাচ্ছেন জনগণের দোরগোড়ায়। দিচ্ছেন নানান প্রতিশ্রুতি।
দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের আধিপত্য থাকলেও ৫ আগস্টের পর জমি দখল ও চাঁদাবাজির মামলায় দবিরুল ইসলাম ও তার ছেলে মাজহারুল ইসলাম সুজন কারাগারে রয়েছেন। অন্যদিকে বাকি নেতাকর্মীরাও পলাতক।
হাসিনা সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন কোণঠাসায় থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা আবারও তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করছে। তবে কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে বেশ কয়েক মাস ধরে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রমে।
ইতোমধ্যে সারাদেশে প্রার্থীতা ঘোষণা করছে বিএনপি। কিন্তু ঠাকুরগাঁও-২ আসনে এখনো কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি দলটি। এবং উপজেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে আপাতত নেই সাংগঠনিক কার্যক্রম। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণা বা সাংগঠনিক তৎপরতা দেখা যায়নি উপজেলা বিএনপির।
তবে জানা গেছে, এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হতে আগ্রহী ছিলেন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক টিএম মাহবুব রহমান ও ডা. আব্দুস সালাম।
অন্যদিকে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে ৫ আগস্টের আগে জণসম্মুখে জামায়াতে ইসলামীর কোনো কার্যক্রম দেখা না গেলেও। ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়েছে দলটি।
এ আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী মাওলানা আবদুল হাকিম। ইতোমধ্যে দলটি প্রচারণা শুরু করেছে। উঠানবৈঠক, সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি করছে। ছুটে বেড়াচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। জনগণকে দিচ্ছে আশ্বাস–প্রতিশ্রুতি। অনেকের মতে এখন পর্যন্ত আসনটিতে জামায়াতের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরাও বিজয়ের আসা প্রকাশ করছেন।
ঠাকুরগাঁও-২ আসনের আরেক প্রার্থী, আন্দোলন- সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দল গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ফারুক হাসান। তিনিও এ আসনে প্রার্থী হিসেবে লড়বেন। তরুণ নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছেন তিনি। তবে আগে তেমন সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা না থাকায় পিছিয়ে আছে দলটি। এরইমধ্যে সভা-সমাবেশ, পথসভাসহ নানা কর্মসূচি করছেন ফারুক হাসান। তরুণ নেতা হিসেবে তরুণদের কিছুটা সাড়া পাচ্ছেন তিনি।
আগামী নির্বাচনের ভাবনা জানতে চাইলে তরুণ ভোটাররা জানান, বিগত নির্বাচন গুলো হয়েছে সেগুলোতে আমরা সুষ্ঠ নির্বাচন দেখিনি। এবং ভোটার হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভোট দেয়ার সুযোগ পাইনি। তবে এবার সুযোগ এসেছে ভোট দেয়ার।
তাই সুষ্ঠ সুন্দর পরিবেশে এবার ভোট দিতে চাই আমরা। আমার ভোটের যাতে মূল্যায়ন হয় সেটা চাই। এবং এমন একজন নেতা চাই বা এমপি চাই যে ঠাকুরগাঁওয়ের উন্নয়নের কথা ভাববে। জনগণের কথা ভাববে। এবং এ জেলাকে কিভাবে উন্নত করা যায় এবং কর্মসংস্থান তৈরি করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করবে আমরা সেই নেতৃত্ব চাই আগামীতে।
সহকারী অধ্যাপক ফজলে ইমাম বুলবুল জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর আমরা নির্বাচন থেকে বঞ্চিত ছিলাম। বিগত দিনে দেখা গেছে যারা নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন তারাই ভোটে কারচুপি করেছে। এবং বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। যার ফলে জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ছিল।
আমরা চাই আগামী দিনে যারা নির্বাচনে মাঠে কাজ করবে। আগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জরুরী। এবং জনগণের যে ভোটের অধিকার প্রয়োগে নিরাপত্তা বলই এমনভাবে সাজিয়ে রাখা উচিত যেন স্বচ্ছ থাকে। সাধারণ মানুষ তার মূল্যবান ভোটটি যাতে করে পছন্দের প্রার্থীকেই দিতে পারে এটাই প্রত্যাশা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাহ মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচন গুলো নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। এবং ভোটারদের স্বাধীনতা হনন করা হয়েছিল। তবে জুলাই পরবর্তী সময়ে নির্বাচন নিয়ে জনগণের মাঝে ব্যাপক উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও দুই আসনে যেহেতু বিএনপি কোন প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তাই সেখানে বিএনপির কেউ মাঠে নেই তবে জামায়েত এবং গণধিকার পরিষদ সেখানে মাঠে রয়েছে এবং জামাতের জনসভায় ভোটারদের উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। এবং ওই আসনটিতে ওই এলাকার মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করবে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিএনপি যেহেতু এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি তাই শেষ অব্দি বলা যাচ্ছে না পরিস্থিতি।
নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিগত দিনে নেতারা শুধু উন্নয়নের নামে দুর্নীতি করেছে। তবে এবার সকলের চায় যে নেতা জনগণের কথা বলবে দেশের জন্য চিন্তা করবে এমন নেতৃত্ব। এবং এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, আগামীর নির্বাচনের জন্য আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগ জনক। এর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে যাতে করে নির্ভয়ে একটি সুন্দর পরিবেশে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে। এবং তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে
উল্লেখ্য যে, ঠাকুরগাঁও-২: দবিরুল-যুগের অবসান কি আসছে?
এই আসনে দীর্ঘদিন ধরে একক আধিপত্য বজায় রেখেছেন আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞ রাজনীতিক দবিরুল ইসলাম। তবে ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর এবার তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন দলের নতুন মুখ মাজহারুল ইসলাম সুজন।
অন্যদিকে, এবার মাঠে রয়েছে একাধিক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের কেন্দ্রীয় সুরা সদস্য আব্দুল হাকিম, জেলা বিএনপির সভাপতি মির্জা ফয়সাল আমিন, সাবেক এমপি জেড মর্তুজা চৌধুরী তুলা, গণ অধিকার পরিষদের ফারুক হাসান, এছাড়াও উপজেলা বিএনপির নেতা এটিএম মাহাবুর রহমান ও ডা. আব্দুস সালাম রয়েছেন আলোচনায়।
ভোটের পরিসংখ্যান
মোট ভোটার ৩ লাখ ৬৮ হাজার ২৫ জন, এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৬৮, নারী ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩০৫, তরুণ ভোটার ৯০ হাজার ৮৭৭, সংখ্যালঘু ভোটার ৪৪ হাজার ৬৯৮।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ আসনে তরুণ ভোটারদের সিদ্ধান্তই ফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে। এছাড়া জামায়াত নেতা আব্দুল হাকিমের জনপ্রিয়তা ও স্থানীয় পর্যায়ে নেটওয়ার্ক তাকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করেছে।
মন্তব্য করুন