

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


রংপুরের তারাগঞ্জে আজ রোববার (২ নভেম্বর) বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন নুপুর রবিদাস। ঘরে চলছে বিয়ের সাজসজ্জা, উঠোনে টাঙানো রঙিন প্যান্ডেল, গেটে ফুলের তোড়া।
দু’দিন আগে থেকেই কাজ শুরু করেছেন ডেকোরেটর শ্রমিকরা। বরযাত্রীদের আপ্যায়নের জন্য জবাই করা হয়েছে তিনটি খাসি। কিন্তু আনন্দের মধ্যেও গভীর শোক-এই বিয়ের সব আয়োজনই হচ্ছে এক অসহনীয় স্মৃতির ভার নিয়ে।
নুপুরের বাবা রূপলাল রবিদাস আর বেঁচে নেই। মেয়ের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে গিয়ে তিনি প্রাণ হারান নির্মম গণপিটুনিতে। গত আগস্টে চুরির অপবাদে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রূপলাল (৪০) ও তার জামাই প্রদীপ দাসকে (৩৫)।
রূপলাল ছিলেন তারাগঞ্জ বাজারের এক জুতা মেরামতকারক, যিনি নিজের সামান্য আয়ে সংসার চালাতেন। নুপুর ডিগ্রিপড়ুয়া মেয়ে, তার ছোট বোন রুপা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে এবং ভাই জয় নবম শ্রেণির ছাত্র। সংসারের ভার প্রায় একাই সামলাতেন রূপলাল, স্ত্রী ভারতী রানী তখন অসুস্থ ছিলেন।
হিন্দু ধর্মীয় আচার অনুযায়ী বিয়ের সব আয়োজন নিজ হাতে সামলাচ্ছেন মা ভারতী রানী। স্বর্ণালঙ্কার, ঘরসজ্জা সামগ্রী ও বরযাত্রীদের আপ্যায়নের জন্য প্রায় ৪০০ অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
নুপুর রবিদাস বলেন, ‘আমার বিয়ের আয়োজন হলেও মনের ভেতরে বাবা হারানোর কষ্ট রয়ে গেছে। আমার বাবার হত্যাকারীরা এখনও অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই দেখছে, কিন্তু কেউ তাদের বিষয়ে কিছু করছে না। পুলিশও তাদের গ্রেপ্তার করছে না।’
জয় রবিদাস বলেন, ‘বাবা নেই, এই বয়সে আমাকে বিয়ের সব কাজ করতে হচ্ছে। হাট থেকে খাসি কিনে এনেছি। জামাই বাবুকে উপহার দেওয়ার জন্য, ঘর সাজানোর সরঞ্জাম কিনেছি। এছাড়া স্বর্ণের আংটি, চেইন, চুড়ি দিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রশাসনসহ কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। আমার মামা আমাদের অভিভাবক হিসেবে দেখাশোনা করছেন।’
ভারতী রবিদাস বলেন, ‘আমার স্বামী ও জামাইকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমার বাড়িতে। তারা কীভাবে পড়াশোনা করবে, আমি কীভাবে সংসার চালাব, তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি। মেয়ের বিয়েতে অনেক টাকা লাগছে। এখন ধার-দেনা করে মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে। যদি কেউ সহযোগিতা করতেন, উপকার হতো। অনেকেই তো কথা দিয়েছিল, কিন্তু এখন কেউ খোঁজ রাখে না।’
স্থানীয় প্রশাসন কিছু সহায়তা দিয়েছে। তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুবেল রানা জানিয়েছেন, নুপুরের বিয়ের জন্য উপজেলা তহবিল থেকে এক লাখ টাকা এবং সমাজসেবা কার্যালয় থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নুপুরের পড়াশোনার জন্য শিক্ষাভাতা, ভারতী রবিদাসের জন্য বিধবাভাতা এবং জয়লালের ব্যবসার জন্য দোকানঘরের বরাদ্দ করা হয়েছে।
গত ৯ আগস্ট রাতে মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া এলাকা থেকে নুপুরের জামাই প্রদীপ রালকে নিয়ে রূপলাল বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় কয়েকজন তাদের পথরোধ করে চোর সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সন্দেহভাজনরা প্রদীপের ব্যাগ তল্লাশি করে ‘স্পিড ক্যানের’ বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় এবং কিছু ওষুধ পান।
বোতল খোলার পর এলাকার কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়লে উত্তেজিত জনতা রূপলাল ও প্রদীপকে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে আসে। লাঠিসোঁটা ও লোহার রড দিয়ে মারধরের একপর্যায়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করা হয়। রূপলালকে মৃত ঘোষণা করা হয়, এবং পরদিন প্রদীপও মারা যান।
এই ঘটনায় ১০ আগস্ট ভারতী রানী তারাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মন্তব্য করুন
