বুধবার
১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বুধবার
১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মাটিতে পড়ে চিৎকার করছিল ময়না—‘আমরা কারে ভাই ডাকমু গো’

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৯ পিএম
মাটিতে পড়ে চিৎকার করছিল ময়না—‘আমরা কারে ভাই ডাকমু গো’
expand
মাটিতে পড়ে চিৎকার করছিল ময়না—‘আমরা কারে ভাই ডাকমু গো’

ঘরের মাটিতে বসে বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন তরুণী ময়না। পাশে কাঁদছিলেন তাঁর খালা মাজেদা খাতুন। চারপাশে শোকাচ্ছন্ন মানুষ। জুলহাস উদ্দিনের বাড়ি আজ যেন আগুনে পুড়ে যাওয়া সেই বাসের মতোই নিস্তব্ধ।

“আমি কারে ভাই ডাকমু গো, আমার মারে কেডা দেখবো গো… আমার ভাইডারে কেডা আগুন দিয়া পুড়াইয়া মারলো গো?”—কথাগুলো বলার পর আবারও লুটিয়ে পড়লেন ময়না। পাশের নারীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, বুকের ভেতরকার হাহাকারটা যেন থামছে না।

জুলহাস উদ্দিন ছিলেন ফুলবাড়িয়া পৌর এলাকার ভালুকজান কৈয়ারচালা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল বারেক ও সাজেদা আক্তার দম্পতির ছেলে। বয়স মাত্র ২৫। আলম এশিয়া পরিবহনের বাসচালক। সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যান তিনি।

ঢাকা থেকে আসা আলম এশিয়া পরিবহনের বাসটি সেদিন রাতে ভালুকজানের ইসলাম পেট্রোল পাম্পের পাশে পার্ক করা ছিল। কাজের শেষে চালক জুলহাস বাসের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েন। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আচমকা আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায় বাসটিতে। স্থানীয়রা দৌড়ে আসার আগেই আগুন পুরো বাসটিকে গ্রাস করে ফেলে।

পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, তিনজন অজ্ঞাত ব্যক্তি পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়। ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, কিন্তু জুলহাসকে তখন আর বাঁচানো যায়নি।

বাসের ভেতরে থাকা এক নারী ও তাঁর ছেলে সন্তান জানালা ভেঙে বের হয়ে বেঁচে যান। তাঁরা হলেন উপজেলার চক রাধাকানাই গ্রামের শহিদুল ইসলাম ও তাঁর মা শারমিন সুলতানা। তাঁরা দুজন ঢাকা থেকে ফিরেছিলেন। গভীর রাত হওয়ায় তাঁরা বাড়িতে না গিয়ে বাসে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন। আগুন দেওয়ার পর মা ও ছেলে দগ্ধ অবস্থায় বাস থেকে নামেন। বর্তমানে তাঁরা ঢাকার নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে জুলহাসের মা সাজেদা আক্তার প্রায়ই জ্ঞান হারাচ্ছেন। ছেলেকে হারানোর পর তিনি শুধু একটা কথাই বলছিলেন— “আমার পোলাডারে আগুনে পুড়াইয়া মাইরা ফালাইছে, এখন আমি বাঁচমু কেমনে গো?”

পরিবারের বড় ছেলে জুলহাসই ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। কয়েক বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর থেকেই তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন মা ও ছোট বোনের।

ভগ্নিপতি সাঈম হোসেন, যিনি স্থানীয় মসজিদের ইমাম, বললেন, “ছেলেটা শান্ত, পরিশ্রমী ছিল। আল্লাহর উপর ভরসা করে হেলপার থেকে চালক হয়েছে। এখন ওর মা-বোনরা পুরোপুরি ভরসাহীন।”

জুলহাসের স্ত্রী জাকিয়া আক্তারের বয়স এখন মাত্র বিশ। এক বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়। কথা বলতে গিয়ে বারবার কেঁপে উঠছিলেন তিনি। “আমার স্বামী খুব কষ্ট করে সংসার চালাত। বলত, একটু টাকা জমলে পাকা ঘর তুলব। পাঁচ মাস হলো চালক হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। এখন সব শেষ। আমার স্বপ্নও পুড়ে ছাই হয়ে গেল।”

পরিবারের আছে মাত্র পাঁচ শতাংশ ভিটেমাটি। জুলহাসের সামান্য উপার্জনেই চলত তাঁদের দিন। এখন সেই আয়ও নেই, নেই ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।

ফুলবাড়িয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান জানান, “বাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়ার ঘটনা সিসিটিভিতে ধরা পড়েছে। তিনজনকে দেখা গেলেও এখনো শনাক্ত করা যায়নি। ফুটেজ বিশ্লেষণ চলছে। মামলা প্রক্রিয়াধীন।”

ভালুকজানের কৈয়ারচালা গ্রামের মানুষ এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ এমনভাবে পুড়ে মরতে পারে। আর জুলহাসের বাড়িতে প্রতিদিন ভিড় করছে স্বজন ও প্রতিবেশীরা— কেউ চুপচাপ বসে, কেউবা কাঁদছে ময়নার সঙ্গে।

ময়না বারবার এক কথাই বলছে, “আমার ভাইডারে ধইরা আইন্নেগো ফাঁসি দিক। না পাইলে আমি নিজের হাতে বিচার কইরুম গো।”

কিন্তু চোখের পানিতে ভেসে যাওয়া সেই বাড়ির নীরবতা যেন জানিয়ে দিচ্ছে— এ বাড়িতে এখন শুধু শোকেরই বসবাস।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন