সোমবার
০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার
০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লালচান বাদশা এখন লালমনিরহাটের গর্ব

লালমনিরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:১৬ এএম
মা-বাবার সঙ্গে লালচান বাদশা
expand
মা-বাবার সঙ্গে লালচান বাদশা

দারিদ্র্যকে সঙ্গী করেই স্বপ্ন বুনছে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র লালচান বাদশা। খেলাধুলায় একের পর এক সাফল্য অর্জন করে সে এখন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গর্ব।

সম্প্রতি জাতীয় পর্যায়ের সাঁতার প্রতিযোগিতায় সারা বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে নিজের পরিবারসহ পুরো এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে এই প্রতিভাবান কিশোর।

লালচান বাদশা আলহাজ গহের আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত এই বিদ্যালয় থেকেই সে নিয়মিত পড়াশোনা ও খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছে। তার বাবা সুলতান একজন অটোচালক, মা নাছিমা খাতুন গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে লালচান সবচেয়ে বড়। পাঁচ সদস্যের এই পরিবারটি অতি কষ্টে দিন পার করছে—নেই থাকার মতো ভালো কোনো ঘর, নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, তবুও থেমে নেই লালচান।

অভাবের সঙ্গে লড়াই করেও লালচান সম্প্রতি জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। সাঁতার ইভেন্টে তার সাফল্য এনে দিয়েছে জেলার মানুষের মুখে হাসি, আর পরিবারে একটুখানি গর্বের আলো।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৫২তম আঞ্চলিক স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ২০২৫-এ লালচান সাঁতার ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে। প্রথমে উপজেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করে, পরে ধারাবাহিকভাবে জেলা, বিভাগ ও চাঁপা অঞ্চলে প্রথম স্থান লাভ করে জাতীয় পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়। গত ২৫ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সে সেখানেও প্রথম স্থান অর্জন করে জেলার মুখ উজ্জ্বল করেছে।

অষ্টম শ্রেণির ছাত্র জিহাদ হোসেন বলেন, “লালচান জাতীয় পর্যায়ে সাঁতারে স্বর্ণপদক অর্জন করেছে। এটা আমাদের সবার জন্যই অপরিসীম গর্বের বিষয়। গ্রামের এক সাধারণ ছেলে আজ তার পরিশ্রম ও প্রতিভা দিয়ে পুরো স্কুলের নাম উজ্জ্বল করেছে। আমরা সবাই তার জন্য খুব আনন্দিত এবং গর্বিত। আমাদের আন্তরিক প্রার্থনা, একদিন লালচান যেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে পারে।”

লিসা খাতুন বলেন, “আমাদের বন্ধু লালচান যে গ্রাম থেকে উঠে এসে জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক জিতেছে, এটা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। আমরা বিশ্বাস করি, সে যদি আরও সুযোগ পায়, তাহলে বিদেশেও দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে।”

সহকারী শিক্ষক এনামুল কবির বলেন, “আমাদের স্কুলটি একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে প্রতিনিয়ত নদীভাঙনের মতো নানা প্রতিকূলতা রয়েছে। সেই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র লালচান জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেছে—এটি আমাদের জন্য এক বিশাল সাফল্য। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী ও এলাকাবাসী সবাই অত্যন্ত আনন্দিত। আমি মনে করি, লালচানের এই অর্জন শুধু আমাদের বিদ্যালয়ের নয়, এটি পুরো দেশের গর্ব।”

দেশসেরা সাঁতারু লালচান বাদশা বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই তিস্তা নদীতে গিয়ে সাঁতার কাটতাম। বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতাম। একদিন আমার স্যার উপজেলায় সাঁতার প্রতিযোগিতায় নিয়ে যান—সেখান থেকেই শুরু। আমাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়, বাবা একজন অটোচালক। সংসার চালাতে তার অনেক কষ্ট হয়। যদি আমাকে সহযোগিতা করা হয়, আমি দেশের বাইরে গিয়েও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উঁচু করে ধরতে চাই।”

লালচান বাদশার বাবা সুলতান হোসেন বলেন, “আমার ছেলে জাতীয় পর্যায়ে সাঁতারে প্রথম হবে—এটা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। দেশবাসীর কাছে ওর জন্য দোয়া চাই। সরকার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে আমার ছেলেটা আরও ভালো জায়গায় খেলতে পারবে।”

আলহাজ গহের আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রওশন আরা বলেন, “লালচান দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার এই সাফল্যের পেছনে পরিবারের সহযোগিতা এবং আমাদের শিক্ষকদের নিরলস পরিশ্রম রয়েছে। ৫২তম স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সে উপজেলায় প্রথম স্থান অর্জন করে, পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়েও প্রথম স্থান লাভ করে। এই দরিদ্র অথচ মেধাবী ছেলেটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি।”

হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম মিঞা বলেন, “লালচান বাদশা দেশসেরা হয়েছে—এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। সে প্রান্তিক পরিবারের সন্তান। আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, তাদের বসবাসের সমস্যা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করব উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা বা গৃহনির্মাণের ব্যবস্থা করতে। সে যদি উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়, সে জন্য উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসকের আন্তরিকতা রয়েছে।”

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন