রবিবার
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রবিবার
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিয়াল আতঙ্কে পদ্মা চরের মানুষ

জাহিদ হাসান সাব্বির, রাজশাহী
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৪ পিএম
রাজশাহীর ষাট বিঘা চরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে শিয়ালের দল
expand
রাজশাহীর ষাট বিঘা চরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে শিয়ালের দল

রাজশাহীর ষাট বিঘা চরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে শিয়ালের দল। তারা বাথানে ঢুকে একরাতে প্রায় ২০০ গরু ও তিনটি মহিষকে কামড়ে দিয়েছে। পরে সকালে দুজন মানুষের ওপর আক্রমণ করে তাদের আহত করেছে।

এরপরও শিয়ালগুলো দূরে না গিয়ে দলবেধে মহড়া দিয়েছে। চরের মানুষ এখন আতঙ্কিত। কোন কৃষক হাসুয়া কিংবা লাঠি হাতে না নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন না।

ষাট বিঘা চর রাজশাহী শহরের ওপারে। ভারতীয় সীমানা লাগোয়া পদ্মা নদীর এ চরে আগে ৩৮০টি বাড়ি ছিল। পদ্মার ভাঙনে বাড়ির সংখ্যা কমতে কমতে এখন মাত্র চারটিতে দাঁড়িয়েছে। এই গ্রামের কিছুটা দূরে বালুচরে বাথান করে গরু-মহিষ রাখা হয়। সেখানে কোনো মানুষ থাকে না।

গত ২০ ডিসেম্বর রাতে ওই বাথানেই হামলা করে শিয়ালের দল। তারা কয়েকটি বাথানের ভেতর ঢুকে প্রায় ২০০ গরু ও তিনটি মহিষকে কামড়ে জখম করে।

ষাট বিঘা চরের বাসিন্দা আফসার আলী ঝুরি বিক্রি করেন। পরদিন সকালে তিনি ঝুরি নিয়ে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে তার চাচাশ্বশুর আক্কাস আলীও ছিলেন। একটি শিয়াল এসে প্রথমে আফসারকে আক্রমণ করে। তখন আফসারকে বাঁচাতে হাতের হাসুয়া দিয়ে শিয়ালকে আক্রমণ করতে যান আক্কাস।

এ সময় আক্কাস আলীর হাতের মাংস তুলে নেয় শিয়ালটি। আর আফসারের ঠোঁট ও একটি আঙ্গুল জখম করে। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাকসিন নেন আহত দুজন।

শনিবার সকালে ষাট বিঘা চরে গরুর বাথানে গিয়ে কথা হয় মাজারদিয়াড় চরের বাসিন্দা আসলাম আলী সঙ্গে। তিনি জানান, শিয়ালগুলো সব গরুর মুখে কামড়েছে। আক্রমণের পর সব গরু বাথান থেকে বের হয়ে যায়।

সকালে ফসলের খেতে গরু চরে বেড়াচ্ছে শুনে তারা ছুটে আসেন। এসে দেখেন, বেশিরভাগ গরুর মুখে জখম। যেসব বাথানের দরজায় জাল দেওয়া ছিল, শিয়াল শুধু সে বাথানগুলোতে ঢোকেনি। অন্য সব বাথানে ঢুকে গরুকে জখম করেছে শিয়াল।

এই বাথানে মোট ১১৬টি গরু ও তিনটি মহিষকে শিয়াল কামড় দেয় বলে জানালেন একটি বাথানের মালিক মো. সিজান। তিনি জানান, তার তিনটি মহিষকে শিয়াল কামড়েছে।

এছাড়া ৪০টি গরুর মধ্যে ২৬টি, আসলামের ২৬টি গরুর মধ্যে ১১টি, কাজিমের ৪০টি গরুর মধ্যে ১৮টি, সুজনের ৩০টি গরুর মধ্যে ২০টি, মাহাবুলের ২৯টি গরুর সবগুলো এবং রিপনের ১৫টি গরুর মধ্যে ১২টিকে শিয়াল কামড় দিয়েছে।

সিজান জানান, পরদিন উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের চিকিৎসক দল আহত গরুগুলোকে ভ্যাকসিন দিতে আসেন। তখনও বাথানের চারপাশে কয়েকটি শিয়াল মহড়া দিচ্ছিল। তেড়ে গেলেও তারা দূরে সরছিল না। শিয়ালের এমন আচরণে তারা আতঙ্কিত। ভয়ে ভয়ে গরু চরাচ্ছেন।

দুপুরে ষাট বিঘা চরে আফসার আলীর বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, তার ঠোঁটে ও হাতের আঙ্গুলে শিয়ালের কামড়ের জখম। কয়দিন ধরে তিনি ঝুরি বিক্রি করতে যেতে পারেননি।

আফসার আলী বলেন, শিয়াল সব বাঘের মত হয়ে গেছে। লাফ দিয়ে এসে আমার ঠোঁটে আক্রমণ করে। তার চাচাশ্বশুরের হাতে হাসুয়া না থাকলে শিয়াল তাদের হয়ত মেরেই ফেলত।

গ্রামে কুকুরের দেখা পাওয়া গেল না। তবে মুরগি ও ভেড়ার ডাকাডাকি শুনলেই আফসারের স্ত্রী ফাহিমা বেগম একটু পর পর ‘আই তু’ বলে কুকুর ডাকছিলেন।

তিনি জানান, প্রচুর শেয়াল হয়েছে। একটু খেয়াল না করলে মুরগি নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই তাদের কয়েকটি মুরগি নিয়ে গেছে। একটি ছাগল ও একটি ভেড়াও শিয়ালের পেটে গেছে।

ফাহিমা জানান, তার স্বামী ও চাচার ওপর হামলার পর কয়েকটি শিয়াল গ্রামের চারজন মানুষকে ধাওয়া দেয়। তারা নদীর পানিতে নেমে পড়ে রক্ষা পান। পরে সেখানে আরও লোকজন জড়ো হয়ে একটি শিয়ালকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তারপরও শিয়াল বাড়ির পাশে ঘুর ঘুর করছে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই বাড়ির দুইপাশে চারটি শিয়ালকে দেখা যায়। আফসারের প্রতিবেশী আবুল কালাম জানালেন, আফসার ও আক্কাসের ওপর হামলার পর একটি শিয়াল তার পাশ দিয়ে হেটে যায়। তখন শিয়ালটির মুখে রক্ত ছিল। তার পাশে এসেই শিয়ালটি মাটিতে মুখের রক্ত মোছে।

গ্রামের কৃষক সুজন আলী জানান, বাথানে তার ২০টি গরুকে জখম করে শিয়াল। তিন দিন আগে মাঠের মধ্যে একটা গরুকে একা পেয়ে চারটি শিয়াল ঘিরে ধরেছিল। পরে সবাই মিলে গিয়ে গরুটিকে রক্ষা করেন। এখন ভয়ে লাঠি ছাড়া লোকজন মাঠে কাজে যাচ্ছে না।

কথা হয় মাজারদিয়াড় গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, শিয়ালের কোনো দোষ নাই। আগের দিন খানপুরের রাখালেরা একটি শিয়ালকে পিটিয়ে মারে। তখন চারটি শিয়াল দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। এরপর রাতেই বাথানে আক্রমণ হয়। শিয়াল এভাবে প্রতিশোধ নিয়েছে।

গ্রামের গরুর রাখালেরা অবশ্য শিয়াল হত্যার অভিযোগ স্বীকার করছেন না। তারা দাবি করছেন, আগের দিন সাঁওতালদের একটি দল এসে জঙ্গলে বুনো শুয়োর, ইঁদুর ও খরগোশ ধরতে অভিযান চালায়। তারা একটি শিয়ালের বাচ্চাও ধরে নিয়ে যায়। এ কারণেই শিয়ালেরা ক্ষুব্ধ হয়ে হামলা শুরু করেছে। এখন মাঠে গরু চরাতেই তারা ভয় পাচ্ছেন।

চরে মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করেন মো. শাকিল। তিনি জানান, কয়েকদিন আগে তার সামনে দুটি শিয়াল এসে দাঁড়িয়েছিল। ভয় পেয়ে তিনি দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যান। গোটা চরের মানুষ এখন শিয়ালের জন্য আতঙ্কে রয়েছেন। কাউকে একা পেলেই শিয়াল তাড়া করছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আতোয়ার রহমান জানান, বাথানে শিয়ালের আক্রমণের খবর পেয়েই তাদের চিকিৎসক দল পাঠিয়েছিলেন। গরুগুলোকে ইতোমধ্যে দুই ডোজ করে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। আরও তিন ডোজ করে দরকার।

এত ভ্যাকসিন তাদের নেই। এ জন্য জেলা প্রশাসককে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি জেলা পরিষদ থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন। তারা বাকি তিন ডোজ ভ্যাকসিনও দেবেন।

পবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল লতিফ জানান, পরদিনই তারা ভ্যাকসিন দিতে যান। মুখে জখম রয়েছে এমন দেখে দেখে তারা ২০০টি গরুকে ভ্যাকসিন দিয়েছেন। বাথানে প্রায় ৬০০ গরু ছিল। এরমধ্যে প্রায় ২০০ গরুকে শিয়াল জখম করে। ভ্যাকসিন দিতে গিয়ে তিনি নিজেই দেখেছেন যে শিয়াল মানুষকেও আক্রমণ করছে।

শিয়ালের এমন আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি ব্যবস্থাপনা বিভাগের রাজশাহীর বন্যপ্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, শিয়ালের প্রজনন মৌসুম ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। এই সময় কেউ শিয়ালদের কেউ বিরক্ত করলে তারা এমন আচরণ করতে পারে। তাছাড়া আবাসস্থল ও খাবারের অভাব শিয়ালের ক্ষুব্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X